লিনিয়ান হায়ারার্কি



বিভিন্ন জীবের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিতে অভিন্ন জীৰসমূহের শ্রেণিবিভাগীয় স্বতন্ত্র গোষ্ঠীকে ট্যাক্সন বলা হয়। প্রাণিরাজ্যের সদস্যদের শ্রেণিবিন্যাসের জন্য সে কাঠামো কতকগুলো ধারাবাহিক স্তরে যেমন- প্রজাতি থেকে প্রাণিরাজ্য পর্যন্ত সাজানো হয় তাকে শ্রেণিবিন্যাস পদসোপান নামে অভিহিত করা হয়। মূলত শ্রেণিবিভাগের বিজ্ঞানসম্মত যে কাঠামোয়ে বিভিন্ন ট্যাক্সা বা গোষ্ঠী ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করে তাকে শ্রেণিবিন্যাস পদসোপান (Taxonomic hierarahy) বলা হয়। (লিনিয়াসের Systema naturac' গ্রন্থের দশম সংস্করণে শ্রেণিবিন্যাস পদসোপানে ৫টি স্তর যথা- Class (শ্রেণি), Order (বর্গ), Genus (গণ), Species (প্রজাতি) ও Varietes (প্রকার) উল্লেখ করেন। ইতোমধ্যে অন্য উৎস থেকে বর্গ ও গণ-এর মধ্যে Family এবং শ্রেণির উপরে Phylum ও Kingdom যুক্ত হয়। Varietes = variety যা উপ-প্রজাতির অনুরূপ এটা বিবর্তনিক একক হিসেবে মর্যাদা না পাওয়া পরিত্যক্ত হয়। অতএব প্রজাতি, গণ, গোত্র, বর্গ, শ্রেণি, পর্ব, রাজ্য পর্যন্ত সাত স্তর বিশিষ্ট শ্রেণিবিন্যাস কাঠামোকে লিনিয়াসের পদসোপান বা লিনিয়ান হায়ারার্কি বলা হয়। লিনিয়ান হায়ারার্কির সাতটি স্তর সম্পর্কে নিম্নে বর্ণনা দেওয়া হলো-))


১. প্রজাতি (Species): শ্রেণিবিন্যাস পদসোপানের সর্বনিম্ন স্তর বা ৭ম একক প্রজাতি নামে পরিচিত। মূলত মায়ার ১৯৪২-এর মতে যে প্রাকৃতিক জনগোষ্ঠীর জীবগুলো নিজেদের মধ্যে আন্তঃপ্রজননে সক্ষম এবং অনুরূপ অন্য জীবগোষ্ঠী থেকে প্রজনন সূত্রে বিচ্ছিন্ন তাকে প্রজাতি বলা হয়। প্রজাতির নিজস্ব সত্ত্বা বিদ্যমান। এরা নিজেদের মধ্যে প্রজনন সম্পন্ন করায় প্রজাতি মূলত একটি জনন সম্প্রদায়। একই প্রজাতির সদস্যরা নিজেদের মধ্যে জিন বিনিময় ও অভিন্ন জিন ভাণ্ডার থেকে জিনের মুক্ত প্রবাহ অব্যাহত রাখে। জীব জগতে প্রতিটি প্রজাতি যেমন নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র তেমনি পরিবর্তিত পরিবেশে অভিযোজিত হওয়া ও নতুন প্রজাতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এরা পরিবেশে একটি বাস্তুসংস্থানিক হিসেবে বাস করে। উদাহরণ- Homo sapiens-এর sapiens অংশটি প্রজাতি।


২. গণ (Genus): শ্রেণিবিন্যাসের পদসোপানের যে সমষ্টিগত ৬ষ্ঠ এককের মধ্যে একই ধরনের বা সম্বন্ধযুক্ত একাধিক প্রজাতি অন্তর্গত থাকে তাকে গণ নামে অভিহিত করা হয়। একই গণভুক্ত প্রজাতিগুলো মূলত একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত এক' জাতিজনি ভিত্তিক একাধিক প্রজাতির সমষ্টি। বাস্তুসংস্থানিক দিক থেকে এরা সাধারণ (common) নিস্ (niche)-এর অধিকারী ও একই প্রণালিতে জীবনযাপন অভ্যন্ত ও অভিযোজিত। গণের বৈশিষ্ট্য অভিযোজনের সাথে সম্পর্কিত। এদের ক্রোমোজোম সংখ্যা প্রকারভেদ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য গণ শনাক্তকরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। উদাহরণ- Homo sapiens এর Homo অংশ গণ।


৩. গোত্র (Family): শ্রেণিবিন্যাসের পদসোপানের যে সমষ্টিগত ৫ম স্তরের মধ্যে সম্বন্ধযুক্ত এক বা একাধিক গণ অন্তর্ভুক্ত থাকে তাকে গোত্র বলা হয়। মূলত একটি গোত্রভুক্ত গণসমূহ একই পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। একই গোত্রের সদস্যরা একই প্রকৃতির বাস্তুসংস্থানগত নিচে অবস্থান করে। গোত্রের পরিধি অনেক বিস্তৃত এমনকি পৃথিবীব্যাপী হতে পারে। গোত্রের পরিধি বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও এদেরকে বাস্তুসংস্থানিক নিচ্ ও অভিযোজনমূলক গুণাবলি দ্বারা নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে ক্ষেত্র বিশেষে গণের বিস্তার একটি বা একাধিক সংলগ্ন অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকে। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ৩১২টি গণভুক্ত প্রাণী শনাক্ত হওয়ায় ক্যারোলাস 'লিনিয়াসকে বর্গ ও গণের মধ্যবর্তী পর্যায় স্তর সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভব করেননি। তবে উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আবিষ্কৃত প্রাণীর সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে যাওয়ায় গণ ও বর্গের মাঝে গোত্র সংযোজন করা হয়। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় লিনিয়াস ব্যবহৃত গণ গোত্রে উন্নীত হয়। উদাহরণ- Hominidae (মানুষের গোত্র বা family)


৪. বর্গ (Order): শ্রেণিবিন্যাস পদসোপানের যে সমষ্টিগত ৪র্থ স্তরের মধ্যে সম্বন্ধযুক্ত সাধারণত কতিপয় গোত্রের একত্রে অবস্থান করে তাকে বর্গ নামে অভিহিত করা হয়। মূলত কতিপয় নিকট সম্পর্কযুক্ত বর্গের সমন্বয়ে শ্রেণিবিন্যাসের পদসোপানে সৃষ্ট ৪র্থ স্তরকে বর্গ নামে চিহ্নিত করা হয়। প্রকৃত পক্ষে বর্গ প্রাকৃতিকভাবে সম্পর্ক যুক্ত গোত্রগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয়ে শ্রেণিবিন্যাসগত ৪র্থ স্তর সৃষ্টি করে। ক্ষেত্র বিশেষে একটি বর্গে একটি মাত্র গোত্র থাকতে পারে। কালের প্রবাহে প্রাণিবিজ্ঞান তথা টেক্সোনমির অব্যাহত ধারাবাহিক উন্নয়নে বর্গের পরিধি বিস্তৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষণে দেখা যায় বহুসংখ্যক গোত্র একেকটি বর্গের মধ্যে স্থান পাচ্ছে। উদাহরণ- Primates (মানুষের বর্গ)।

৫. শ্রেণি (Class)। শ্রেণিবিন্যাসের পদসোপানে বর্ণের পরবর্তী ৩য় অবস্থানে কতিপয় সাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী কতক বর্গের সমন্বয়ে সৃষ্ট স্তরকে শ্রেণি নামে অভিহিত করা হয়। মূলত একাধিক সদৃশ বর্গের সমন্বয়ে শ্রেণি গঠিত হয়। বিবর্তনের ধারা, অভিযোজনের গতিপ্রকৃতি, অঙ্গসংস্থানগত বৈশিষ্ট্য, ব্যস্তুসংস্থানগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি একটি শ্রেণি পাশাপাশি অবস্থিত অন্য শ্রেণি থেকে ভিন্নতা প্রদর্শন করে। শ্রেণির আকার ও গঠন কিরূপ হবে তা নিয়ে প্রাণিবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশই মনে করেন শ্রেণির পরিধি বিস্তার লাভ করলে পর্বে অন্তর্ভুক্ত শ্রেণিসংখ্যা হ্রাস পাবে যা বাঞ্ছনীয়। তবে শ্রেণির পরিধি সংকুচিত হলে পর্বে শ্রেণি সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে অহেতুক জটিলতা বৃদ্ধি পাবে যা কাম্য নয়।

উদাহরণ- Mammalia (মানুষের শ্রেণি)।


৬. পর্ব (Phylum): শ্রেণিবিন্যাস পদসোপানে রাজ্যের পরে ২য় অবস্থানে কতিপয় সদৃশ শ্রেণি একত্রে যে স্তর সৃষ্টি করে তাকে পর্ব নামে অভিহিত করা হয়। উচ্চতর স্তরে শ্রেণির উপরে পর্ব অবস্থান করে। মূলত সদৃশ কতকগুলো শ্রেণির কর্তৃক সাধারণ মূল বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে পর্ব নির্ধারিত হয়। প্রাণিরাজ্যে আবিষ্কৃত প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্গ ও শ্রেণি ইত্যাদির ন্যায় পর্বের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কোষ সংখ্যা, কোষ স্তর, সিলোম, কলাতন্ত্র, দেহের সংগঠন মাত্রা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে প্রাণিজগতে প্রথম দিকে ১০টি পর্ব সৃষ্টি হলেও বর্তমানে তা ৪১টিতে উন্নতি হয়েছে। এসব পর্বগুলোতে প্রাণী প্রজাতির সংখ্যা, বাস্তুসংস্থানগত সম্প্রদায় এর কর্ম সক্রিয়তায় অংশগ্রহণের ব্যাপকতা, আন্তঃপ্রজাতি সম্পর্কের মাত্রা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পর্বগুলোকে মুখ্য (Major) এবং গৌণ (Minor) পর্বে ভাগ করা হয়। মুখ্য প্রজাতি সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি ও গৌণ পর্বের প্রজাতির সংখ্যা ১- ৫০,০০০ পর্যন্ত হয়। প্রাণিজগতে মুখ্য পর্ব ১২টি ও গৌণ পর্ব ২৯টি।


৭.প্রাণিজগত (Animal Kingdom): শ্রেণিবিন্যাস পদসোপানের সর্বোচ্চ বা শিখরে অবস্থিত সকল পর্ব একত্রে যে স্তর সৃষ্টি করে তা প্রাণিজগত নামে পরিচিত। এখানে বহুকোষী, হলোজোয়িক স্বভাবের জীবগোষ্ঠী বিদ্যমান। প্রাণিজগতের প্রায় সকল সদস্য চলাচলে সক্ষম, শ্বসনতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্র বহন করে। এরা যেমন উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করে তেমনি সাধারণত যৌনজননের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। উদাহরণ- স্পঞ্জ থেকে কর্ডাটা পর্যন্ত সকল প্রাণী প্রাণিজগতের অন্তর্ভুক্ত।

Leave a Comment